৬৪/৩০. অধ্যায়ঃ
খন্দকের যুদ্ধ [৩৬]। এ যুদ্ধকে আহযাবের যুদ্ধ ও বলা হয়
মূসা ইবনু ‘উকবাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, এ যুদ্ধ ৪র্থ হিজরী সনের শাওয়াল মাসে হয়েছিল।[৩৬] মুসলিমদের সামরিক তৎপরতা চালানোর ফলে জাজিরাতুল আরাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। চারিদিকে মুসলিমদের প্রভাব প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটে। এ সময় ইয়াহুদীরা তাদের ঘৃন্য আচরণ, ষড়যন্ত্র, এবং বিশ্বাসঘাতকতার নানা ধরনের অবমাননা ও অসম্মানের সম্মুখীন হয়। কিন্তু তবু তাদের ‘আকল হয়নি। খায়বারে নির্বাসনের পর ইয়াহুদীরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, কিন্তু উত্তরোত্তর দূর দূরান্তে ইসলামের জয়জয়কার ছড়িয়ে পড়ার ফলে ইয়াহুদীরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হতে লাগল। হিজরী পঞ্চম সনের ঘটনা। যেহেতু বনু নাযীর খায়বারে নির্বাসিত হয়েও নিশ্চুপে বসে ছিল না সেহেতু তারা মুসলিমদের মুলোৎপাটনের জন্য এক সম্মলিত চেষ্টা চালাবার দৃঢ় সংকল্প করেছিল, যার মধ্যে আরবের সমস্ত গোত্র-উপগোত্রের বীর যোদ্ধা শামিল থাকে।তারা বিশ জন নেতার উপর এই দায়িত্ব অর্পন করে যে, তারা সমস্ত গোত্রকে আক্রমণের জন্যে উত্তেজিত করবে। এই চেষ্টার ফল এই দাঁড়াল যে, হিজরী পঞ্চম সনের যুলকা‘দাহ মাসে (যাদুল মাআ‘দ, ১ম খন্ড, ৩৬৭ পৃষ্ঠা) দশ হাজার রক্ত পিপাসু সৈন্য, যাদের মধ্যে মূর্তিপূজক, ইয়াহুদী প্রভৃতি সবাই শামিল ছিল, মাদীনাহ্র উপর আক্রমণ করে। কুরআন মাজীদে এই যুদ্ধের নাম হচ্ছে আহযাবের যুদ্ধ। যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী গোত্রগুলি হলঃ১। কুরাইশ, বানু কিনানাহ, আহলে তিহামাহ, -সেনাপতি সুফইয়ান ইবনু র্হাব।২। বানু ফাযারাহ-সেনাপতি উকবা ইবনু হুসায়ন।৩। বানু মুররাহ-সেনাপতি হারিস ইবনু আওফ।৪। বানু আশজা‘ ও আহলি নাজদ-সেনাপতি মাস‘উদ ইবনু দাখীলা।মুসলিমরা যখন দেখলেন যে, এই সেনাবাহিনীর সাথে মুকাবালা করার শক্তি তাদের নেই তখন তারা শহরের চতুর্দিকে খন্দক খনন করলেন। দশ দশজন লোক চল্লিশ গজ করে খন্দক খনন করেছিলেন। (তবারী, ২য় খন্ড)মুসলিমদের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। ইসলামী সেনাবাহিনী মাদীনাহর ভিতরেই এভাবে অবস্থান করলেন যে, সামনে ছিল খন্দক এবং পিছনে ছিল সালা (যাদুল মাআ‘দ, ৩৬৭ পৃষ্ঠা) পর্বত। আর ইয়াহুদী, বানু কুরাইযাহ-যারা মাদীনাহয় বসবাস করতো এবং যাদের চুক্তি অনুযায়ী মুসলিমদের সাথে যোগ দেয়া একান্ত যরুরী ছিল-তাদের সাথে রাত্রির অন্ধাকারে বানূ নাযীর ইয়াহুদীদের নেতা হুইয়াই ইবনু আখতাব মিলিত হলো এবং চুক্তি ভঙ্গ করার জন্যে উত্তেজিত করে নিজের দিকে ডেকে নিলো। রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে বুঝাবার জন্যে নিজের কয়েকজন দলপতিকে তাদের নিকট বার বার প্রেরণ করলেন। কিন্তু তারা পরিষ্কারভাবে বরে দিলোঃ “মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে যে, আমরা তাঁর কথা মেনে চলবো? তাঁর সাথে আমাদের কোনই চুক্তি ও অঙ্গীকার নেই। (ইবনু হিশাম, ২য় খন্ড, ১৪১ পৃষ্ঠা)এরপর বানূ কুরাইযাহ শহরের নিরাপত্তায় বাধা সৃষ্টি করল এবং মুসলিম মহিলা ও শিশুদেরকে বিপদে ফেলে দিল। সুতরাং বাধ্য হয়ে তিন হাজার মুসলিম সৈন্যের মধ্য হতেও একটি অংশকে শহরের সাধারণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্যে পৃথক করতে হলো। বানূ কুরাইযাহ মনে করেছিল যে, যখন বাহির হতে শত্রু পক্ষের দশ হাজার বীর যোদ্ধার আক্রমণ সংঘটিত হবে এবং তারা শহরের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা ছড়িয়ে দিয়ে মুসলিমদের নিরাপত্তা নষ্ট করে দিবে তখন দুনিয়ায় মুসলিমদের নাম নিশানা ও বাকী থাকবে না।নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেহেতু স্বাভাবিক যুদ্ধকে ঘৃনার চোখে দেখতেন, সেহেতু তিনি সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন যে, উৎপাদিত ফলের এক তৃতীয়াংশ প্রদানের শর্তে আক্রমনমুখী গাতফান নেতৃবর্গের সাথে সন্ধি করে নেয়া হোক। কিন্তু আনসার দল যুদ্ধকেই প্রাধান্য দিলেন। সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) এবং সা‘দ ইবনু উবাইদাহ (রাঃ) এই প্রস্তুতি সম্পর্কে ভাষন দিতে গিয়ে বলেনঃ “যে সময় প্রদান করিনি। আর আজ যখন মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় দান করেছেন তখন কী করে আমরা তাদেরকে আমাদের উৎপাদিত ফলের এক তৃতীয়াংশ প্রদান করতে পারি? তাদের জন্যে আমাদের কাছে তরবারি ছাড়া কিছুই নেই।” আক্রমণকারী সৈন্যদের অবরোধ এক মাস বা এক মাসের কাছাকাছি পর্যন্ত ছিল। মাঝে মাঝে দু‘একটি খন্ডযুদ্ধও সংঘটিত হয়। আমর ইবনু আবদে ওদ, যে নিজেকে এক হাজার বীর পুরুষের সমান মনে করতো, আল্লাহর সিংহ, আলীর (রাঃ) হাতে নিহত হয়।নওফিল ইবনু আবুদিল্লাহ ইবনু মুগীরাও মুকাবালায় মারা যায়। মক্কাবাসীরা নওফিলের মৃতদেহ নেয়ার জন্যে দশ হাজার দিরহাম মুসলিমদের সামনে পেশ করে। রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদেরকে বলেনঃ “মৃতদেহ দিয়ে দাও, মুল্যের প্রয়োজন নেই।” (ইবনু হিশাম।)যখন তারা অবরুদ্ধ মুসলিমদের কোনই ক্ষতি সাধন করতে পারলো না তখন তাদের সাহস হারিয়ে গেল। পৌত্তলিকদের জোটে ভাঙ্গন ধরার পর এবং তাদের মধ্যে হতাশা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্টির পর আল্লাহ তাদের উপর ঝড়ো বাতাস পাঠিয়ে দিলেন। বাতাস কাফিরদের সব কিছু তছনছ করে দিল। অবশেষে তারা ময়দান ছেড়ে পালিয়ে গেল।
সহিহ বুখারী : ৪১০৬
সহিহ বুখারীহাদিস নম্বর ৪১০৬
أَحْمَدُ بْنُ عُثْمَانَ حَدَّثَنَا شُرَيْحُ بْنُ مَسْلَمَةَ قَالَ حَدَّثَنِيْ إِبْرَاهِيْمُ بْنُ يُوْسُفَ قَالَ حَدَّثَنِيْ أَبِيْ عَنْ أَبِيْ إِسْحَاقَ قَالَ سَمِعْتُ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ يُحَدِّثُ قَالَ لَمَّا كَانَ يَوْمُ الْأَحْزَابِ وَخَنْدَقَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُهُ يَنْقُلُ مِنْ تُرَابِ الْخَنْدَقِ حَتَّى وَارَى عَنِّيْ الْغُبَارُ جِلْدَةَ بَطْنِهِ وَكَانَ كَثِيْرَ الشَّعَرِ فَسَمِعْتُهُ يَرْتَجِزُ بِكَلِمَاتِ ابْنِ رَوَاحَةَ وَهُوَ يَنْقُلُ مِنْ التُّرَابِ يَقُوْلُ:اللهُمَّ لَـوْلَا أَنْتَ مَـا اهْـتَـدَيْـنَـا وَلَا تَصَـدَّقـْنـَا وَلَا صَـلّـَيـْنـَافَأَنْـزِلَنْ سَـكِيْنَـةً عَـلَـيْـنَـا وَثَـبِّـتِ الْأَقْـدَامَ إِنْ لَاقَـيْـنَـاإِنَّ الْأُلَى قَـدْ بَـغَـوْا عـَلـَيـْنـَا إِذَا أَرَادُوْا فِــتْــنَـةً أَبَـيْـنَـاقَالَ ثُمَّ يَمُدُّ صَوْتَهُ بِآخِرِهَا
বারাআ (রাঃ) হতে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আহযাব (খন্দক) যুদ্ধের সময় রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিখা খনন করেছেন। আমি তাঁকে খন্দকের মাটি বহন করতে দেখেছি। এমনকি ধূলাবালি পড়ার কারণে তার পেটের চামড়া ঢেকে গিয়েছিল। তিনি অধিকতর পশম বিশিষ্ট ছিলেন। সে সময় আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে মাটি বহন রত অবস্থায় ইবনু রাওয়াহার কবিতা আবৃত্তি করে শুনেছি। তিনি বলছিলেনঃহে আল্লাহ! আপনি যদি হিদায়াত না করতেন তাহলে আমরা হিদায়াত পেতাম না, আমরা সদাকাহ করতাম না এবং আমরা সালাতও আদায় করতাম না।সুতরাং আমাদের প্রতি আপনার শান্তি অবতীর্ণ করুন, এবং দুশমনের সম্মুখীন হওয়ার সময় আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখুন।অবশ্য মক্কাবাসীরাই আমাদের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছে, তারা ফিতনা বিস্তার করতে চাইলে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছি।বর্ণনাকারী (বারাআ) বলেন, শেষের কথাগুলি তিনি টেনে আবৃত্তি করছিলেন। [২৮৩৬] (আ.প্র. ৩৮০০, ই.ফা. ৩৮০৩)